সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: দক্ষিণ চট্টগ্রামের নিভৃতচারী এক সাংবাদিকের নাম সৈয়দ আহানুল হুদা। যিনি মনে প্রাণে আজীবন দেশপ্রেম লালন করতেন। মানুষের অধিকার পূরণ ও ন্যায্যতা নিশ্চিতের কথা বলতেন। ধার্মিক মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগমন কামনা করতেন। তবে, কখনো সাম্প্রদায়িকতা চর্চা করেননি। সৈয়দ আহসানুল হুদার জন্ম দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ডুমুরিয়া সৈয়দ বাড়িতে। পীর পরিবারে জন্মে বলেই শৈশব থেকেই আদর্শ নৈতিকতা চর্চা করতেন। শাহজাদা হয়েও কোন প্রকার দাম্ভিকতা ছিল না। ধনী -গরীব বা মুসলিম-ননমুসলিম তফাৎ করেননি। সাংবাদিকতা, গবেষণা ও লেখালেখি ছিল সৈয়দ আহসানুল হুদার নেশা, পেশা ও সাধনা। মহান সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা করে গণমানুষের সেবা করতেন। মৃত্যুকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সাংবাদিক। অত্যান্ত আন্তরিকতা ও সততার সাথে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করতেন।
১৯৭৭ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন সৈয়দ আহসানুল হুদা। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিনিধি বন্ধুবর মোহাম্মদ মোরশেদের একটি লেখায় জানা যায়, তাঁর সাথে উপজেলার ছোট বড় সকল শ্রেণি পেশার মানুষ বিশেষ করে সাংবাদিকদের সাথে মধুর সখ্যতা ছিল। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন অনেকেই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে। আর জেনে নিতেন কীভাবে তিনি আনোয়ারার সেরা মানুষদের মধ্যে একজনে পরিণত হলেন। সৈয়দ আহসানুল হুদা বলতেন, সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করতে আর কাজের মূল্যায়ন করবে তারাই। এর প্রমাণও পাওয়া যায়, তাঁর অসুস্থতার সময়ে। অসুস্থ অবস্থায় আমরা দেখেছি, তাঁকে দেখতে, দোয়া করতে অনেক রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুকও তার ঘরে গিয়েছেন। তাঁকে স্পর্শ করিয়ে, মুরগী সদকা করতে দেখা গিয়েছিল অনেককে। অনেক মসজিদ-মাদরাসায় তাঁর রোগমুক্তির জন্য খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল করা হয়েছিল। দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে ভারতে চিকিৎসাধীন থাকার সময় সৈয়দ আহসানুল হুদার সাথে স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। অন্যদিকে ভারত থেকে আসার পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের সহায়তায় ছুটতে দেখা গেছে সৈয়দ আহসানুল হুদাকে। অসহায়দের সাহায্য করতেন কোন ধরনের উদ্দেশ্য ছাড়াই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি থাকতে পেরেছেন সৎ, নির্মোহ ও নির্ভীক। সৈয়দ আহসানুল হুদা বলতেন, সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করতে আর কাজের মূল্যায়ন করবে তারাই। এর প্রমাণও পাওয়া যায়, তাঁর অসুস্থতার সময়ে। অসুস্থ অবস্থায় আমরা দেখেছি, তাঁকে দেখতে, দোয়া করতে অনেক রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুকও তার ঘরে গিয়েছেন। তাঁকে স্পর্শ করিয়ে, মুরগী সদকা করতে দেখা গিয়েছিল অনেককে। তাছাড়া, আনোয়ারার অনেক মসজিদ-মাদরাসায় তার রোগমুক্তির জন্য খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল করা হয়েছিল। সৈয়দ আহসানুল হুদা পত্রিকায় কখনো কোনো সংবাদ কিংবা ফিচারে ক্যান্সার শব্দটি দেখলে কলম দিয়ে কেটে দিতেন। শব্দটি কেন কাটছেন জানতে চাইলে তিনি বলতেন, আমার মা-ভাগ্নেসহ অনেকে প্রাণ হারান এ রোগে, তাই এ শব্দটা আমি কোথাও পেলে কেটে দিই। অথচ তিনিও সেই মরণব্যাধী ক্যান্সারে মারা গেলেন। শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার অনেক আগে থেকেই সৈয়দ আহসানুল হুদা কোনো ডাক্তারের কাছে গেলে পরীক্ষা দিলে করাতে চাইতেন না। যদি কোন খারাপ রিপোর্ট আসে এই ভেবে। ২০০৮ সালের মে মাসের দিকে তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লে আনোয়ারার মানুষজন বিচলিত হয়ে পড়েন। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেয়ার সময় ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন, কেমোথেরাপির মাধ্যমে এ রোগ থেকে সেরে ওঠা যাবে। তবে টাকা লাগবে ১০ লাখেরও বেশী। কিন্তু এত টাকা সংগ্রহ করা তাঁর জন্য অসম্ভব। শহরের কয়েকজন সাংবাদিক, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু, আনোয়ারায় সহকর্মী সাংবাদিক, শিক্ষক ও সর্বস্তরের মানুষ চিকিৎসার উদ্যোগ নেন। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে সৈয়দ আহসানুল হুদাকে। উন্নত চিকিৎসা ও থেরাপি দেয়ার জন্য ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে পাঠানো হল তাঁকে। যখন তিনি প্রথমবার ভারত যাচ্ছিলেন তখন তার কণ্ঠস্বর ছোট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম থেরাপিতেই তিনি পেলেন সফলতা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল মুখের আওয়াজ। প্রথম কেমো দেয়ার পর ভারত থেকে হাসিমুখে আসার পর আবার নতুন উৎসাহ নিয়ে পুরোদমে শুরু করলেন সাংবাদিকতা। আর সংবাদ কিংবা লোকালয়ের ফিচার পাঠানোর জন্য আমাকে তাঁর পাশে থাকতে হতো সবসময়। কেননা, আজাদীর বেতন ছাড়া তার আর কোনো পথ ছিল না। কারো কাছ থেকে কোন সুবিধা না নেয়ার কারণে তাকে ভরসা করতে হতো আজাদীর বেতন-ভাতার উপর। কেমো দেয়ার পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সৈয়দ আহসানুল হুদাকে নিয়ে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ডা. শরিফুল আলমের কাছে যাই। সে সময় তিনি আমাকে জানান চিকিৎসা শেষে আগামী দিনগুলোতে আনোয়ারার অবহেলিত মানুষগুলোর জন্য কী কী কাজ হাতে নেবেন। ডা. শরিফুল আলমের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে শেষবারের মতো ভারত গিয়ে তিনি ডাক্তারের সাথে দেখা করে চলে আসবেন। কেননা, তিনি ভালো হয়ে গেছেন পুরোপুরি, ভারতের ডাক্তারের পরামর্শের জন্যই মাত্র ভারত যাওয়া। কিন্তু বিধিবাম। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, শরীরের রোগ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আর পুণরায় চিকিৎসা করাতে লাগবে ন্যূনতম ১৮ লাখ টাকা। হতাশ হয়ে দেশে ফিরে ঢাকার একটি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেয়া হত। এমনি সময় ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ও ২ মেয়ে এবং ভক্ত-শুভাকাঙ্ক্ষী। নির্লোভ ও নিভৃতচারী সাংবাদিক সৈয়দ আহসানুল হুদার আজ (১৭ নভেম্বর ২০২৪, রোববার) ষোড়শ মৃত্যু বার্ষিকী। মৃত্যু বার্ষিকীতে আনোয়ারায় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
Leave a Reply